অনন্ত জীবনের নিদর্শন ও নির্দেশনা

দীর্ঘ জীবন লাভ মানুষের এক নিরন্তর স্বপ্ন। এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে অন্তহীন। বর্তমানে জীব-প্রযুক্তির (Bio tech) গবেষণায় দীর্ঘস্থায়ী জীবনের সূত্র বুঝতে খুঁজে ফেরা হচ্ছে আনুষঙ্গিক জীন (Gene) এবং প্রোটিন। অথচ বিশ্ব জগতের শ্রেষ্ঠতম জ্ঞান কোষ আল-কোরআনে বিশ্ব স্রষ্টা পরম করুণাময় বর্ণনা করেছেন অনন্ত জীবন লাভের ভিন্ন এক পদ্ধতি। সূরা-কাহাফের ৯ থেকে ২৫ আয়াতে গুহাবাসী যুবকদের তিনশ’ নয় বছর বেঁচে থাকার অনুপূর্ব বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামিন মানব জাতির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখেছেন।

‘তুমি কি এই ঘটনাকে আমার অন্যান্য বিস্ময়কর নিদর্শনের চেয়েও আশ্চর্যজনক মনে কর?’ (আয়াত-৯)

উল্লেখ্য, মানুষকে সত্য পথের সন্ধান দিতে গিয়ে পবিত্র কোরআন জুড়ে আল্লাহ পাক তার বিবিধ সৃষ্ট নিদর্শনের বর্ণনা দিয়েছেন এবং সেগুলোকে উল্লেখ করেছেন চিন্তাশীলদের জন্য জ্ঞান লাভের উৎস হিসাবে। সেই সব সৃষ্টির তুলনায়, এমনকি মানুষের নিজের সৃষ্টির তুলনাতেও গুহাবাসী যুবকদেরকে দীর্ঘ জীবনদান আল্লাহর জন্য কোন অবস্থাতেই কঠিন কোন কাজ ছিল না।

অথচ মক্কার বিধর্মীরা এটাকেই উপযুক্ত চ্যালেঞ্জ হবে মনে করে জানতে চেয়েছিল রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে। ঘটনার সত্যতার সাক্ষ্য দিয়ে আল্লাহ বলেন-

‘আমি সেই গুহাবাসীদের সত্য ইতিবৃত্ত আপনার কাছে যথাযথভাবে বর্ণনা করছি।’ (আয়াত-১৩)

সূরা কাহাফের উল্লেখিত ১৬টি আয়াতের পর্যালোচনায় দেখা যায়, নিজ জাতির অনাচার এবং অবিশ্বাসী যুলুমবাজ রাজার কুফুরী নির্দেশাবলী থেকে নিজেদের ঈমান রক্ষায় কয়েকজন যুবক সৎপথ প্রদর্শনের প্রার্থনা করেছিল আল্লাহর দরবারে। তারই ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তাদেরকে লোকালয় থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন নির্জন পার্বত্যাঞ্চলে।

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, আল্লাহ ঐ যুবকদেরকে নিজ জনপদে রেখে ধর্মপ্রচারে নিয়োজিত করেননি অথবা তাদেরকে অন্যকোন নিরাপদ লোকালয়েও সরিয়ে নেননি। এটার কারণ নিঃসন্দেহে পাহাড়ের গুহায় দীর্ঘ বসবাসের নিদর্শন সৃষ্টি করা যা কিনা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হয়ে থাকবে গবেষণার উৎস যা থেকে সম্ভব হবে মানবজাতির জন্য প্রয়োজনীয় এবং কল্যাণকর উদ্ভাবন।

একটি পোষা কুকুরসহ গুহার ভেতরে এই যুবকদের ঘুমের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘তাদের কর্ণের উপর ফেলা হয়েছিল নিদ্রার আবরণ (Barrier) এবং তাদের দিকে তাকালে মনে হতো যেন তারা জেগে আছে।’ ঘুম সংক্রান্ত চূড়ান্ত এক সত্যের প্রকাশ ঘটেছে এই বর্ণনায়। এখানে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে ঘুমের সাথে চোখ নয় বরং সরাসরি জড়িত আমাদের কান বা শ্রবণেন্দ্রিয়। শুধু তাই নয় যুবকদের চোখগুলো এমনভাবে খোলা ছিল যাতে মনে হবে যেন তারা ‘জেগে আছে।’

ঘুম বিষয়ে সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকেও আমরা জানি যে ঘুমের মধ্যে আমাদের শ্রবনেন্দ্রিয় নিস্ক্রিয় থাকে তাই পরিপার্শ্বে ঘটমান নির্দিষ্ট মাত্রার শব্দাবলী আমরা শুনি না। বড়সড় বা প্রচণ্ড কোন শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ হচ্ছে শব্দের মাত্রাধিক্য যা কিনা ছাড়িয়ে যায় কানের উপর ঘুমের আবরণের শব্দ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে। প্রমাণস্বরূপ আরো লক্ষ্যণীয়, কিছু ব্যক্তি আছেন যারা রাতের নিঝুম নিস্তব্ধতায় এমনকি ঘড়ির কাটার টিক টিক শব্দের মাঝেও ঘুমাতে পারেন না। কোরআনের ঘুম বিষয়ক তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, তাদের কানের উপরের ঘুমের আবরণ নিতান্তই ক্ষীণ এবং দুর্বল। এক্ষেত্রে শ্রবনেন্দ্রীয়ের স্পর্শকাতরতা (Sensitivity) কমানোর চিকিৎসা তাদের সুনিদ্রাকে নিশ্চিত করতে পারে বলেই মনে হয়।

অতঃপর বর্ণনা করা হয়েছে যুবকদের গুহার প্রশস্ততা, গুহার সুনির্দিষ্ট মধ্যভাগে তাদের অবস্থান এবং দিবাভাগে গুহাকে কেন্দ্র করে সূর্যের নির্দিষ্ট পরিক্রমণ পথ। বলা হয়েছে ‘তুমি সূর্যকে দেখবে যখন উদিত হয় তখন গুহা থেকে দক্ষিণে বা ডানে সরে যায় আর যখন অস্তমিত হয় তখন সরে যায় বামদিকে এবং তারা শায়িত ছিল প্রশস্ত গুহার ঠিক মধ্যখানে।’ (আয়াত-১৭)

এই আয়াতের শেষে এটাও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে ‘এর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীলদের জন্য।’

বস্তুত পচনশীল দ্রব্য বা বস্তুর দীর্ঘস্থায়ী সংরক্ষণ (Preservation) এর অনুপম প্রাকৃতিক পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে এই আয়াতে। এখানে এটা স্পষ্ট যে জীব দেহের মত বস্তুকে দীর্ঘস্থায়ী সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন বিশেষ মাপের কক্ষ বা গৃহ যার সাথে সূর্যের গমনাগমন তথা দিনব্যাপী সূর্য রশ্মির প্রক্ষেপণে থাকবে সুনির্দিষ্ট জ্যামিতিক সম্পর্ক।

খুব সম্ভবতঃ এই নির্দিষ্ট ধরনের নির্মাণ কৌশল কিছুটা হলেও জানত মিশরীয় ফারাওরা। তাদের তৈরি পিরামিডের সৃষ্টি শৈলীতে ঠিক এ ধরনেরই প্রযুক্তির প্রয়োগ হয়েছিল বলে সাম্প্রতিক গবেষণাবলীতে জানা যায়। এই নির্দিষ্ট নির্মাণশৈলীর অবকাঠামোতে যে কোন পচনশীল বস্তুর দীর্ঘস্থায়ী সংরক্ষণ যে সম্ভব তাও জানা গেছে পিরামিড সংক্রান্ত ঐসব গবেষণায়। তবে আসহাবে কাহাফের গুহাটা আরো নিখুঁত এক সংরক্ষণাগার যা কিনা যুবকদেরকে তিনশতাধিক বছরব্যাপী জীবিত সংরক্ষিত রেখেছিল ভয়ানক কোন ক্ষুৎ-পিপাসা বা পানিশূন্যতা (Dehydration) ছাড়াই। তাই ঘুম থেকে জেগে তাদের মনে হয়েছিল তারা একদিন বা তার কিয়দাংশ ঘুমিয়েছে। কিন্তু নিজেদের জীর্ণ পোশাক, দীর্ঘ চুল-দাড়ির দিকে লক্ষ্য করে দ্রুতই তাদের সেই ভুল ভেঙ্গে যায়। এ পর্যায়ে তাদের অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেন-‘তোমরা যদি তাদের দেখতে তবে ভয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন পূর্বক পলায়ন করতে (আয়াত-১৮)

এ থেকে বোঝা যায় গুহার ভেতরের অবস্থা ছিল অত্যন্ত কঠোরভাবে তাপানুকূল যে জন্য ঘুমন্ত যুবকদের স্বাভাবিক শারীরিক কার্যক্রম (Body metabolism) সচল থাকলেও তার গতি ছিল ধীর (slow) এবং সুনিয়ন্ত্রিত। এছাড়াও ঘুমের মধ্যে তাদের পাশ পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে ‘আমি করাতাম’ বলা হয়েছে যা থেকে বোঝা যায়, ঘুমের ঘোরে আমরা যে পাশ পরিবর্তন করি সেটা আসলে আমাদের নয় বরং মহাজ্ঞানী আল্লাহর ইচ্ছা এবং নির্দেশেই হয়ে থাকে।

নিজেদের ঘুমের দৈর্ঘ্য বা পরিমাণ সংক্রান্ত উল্লেখিত বিতর্ক থেকে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি সেই গুহাবাসী যুবকেরা। তাই ‘এ বিষয়ে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন’ বলে বিতর্কের ইতি টেনেছিল তারা। কিন্তু আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। আল্লাহ বলেন-‘আমি এদের বিষয়টিকে প্রকাশিত করতে চেয়েছিলামঃ’ (আয়াত-২১)

তাই, আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী যুবকেরা তাদের মধ্য থেকে একজনকে যখন খাবার কিনতে লোকালয়ে পাঠিয়েছিল তখন তিন শতাব্দীকালের পুরনো মুদ্রার কারণে তাদের সুদীর্ঘ নিদ্রার ঘটনা প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল সর্বজন সমক্ষে।

এই একই আয়াতের পর্যালোচনায় আরো বোঝা যায় যে তিন শতাধিক বছর পরের ঐ জনপদবাসীরা ছিল এক আল্লাহতে বিশ্বাসী ঈমানদার জনগণ। তাই তারা আগ্রহী হয়ে ওঠে গুহাবাসীদের পুরো অবস্থা জানতে এবং যুবককে সাথে নিয়ে পৌঁছে যায় ঐ পাহাড়ী এলাকায়। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক এক পর্যায়ে ঐ যুবক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় জনতা। সম্ভবতঃ জনতাকে বাহিরে রেখে সঙ্গীদের ডেকে আনতে গিয়ে আল্লাহর ইচ্ছাতেই আর ফিরতে পারেনি ঐ যুবক এবং জনগণও আর খুঁজে পায়নি মূল গুহা এবং সেই গুহাবাসীদের।

সর্বশক্তিমান আল্লাহ ইচ্ছা করলে পারতেন সেই সুরক্ষিত গুহায় ঘুমের মধ্যে তাদের জান কবজ করে তাদের মরদেহগুলো সংরক্ষণ করতে। কিন্তু তা না করে তাদেরকে প্রকাশিত করে দেয়া এবং তাদের অবস্থান স্থলের অনুপূর্ব বর্ণনা কোরআনে বিধৃত করে আল্লাহ স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তার সৃষ্টি তত্ত্ব অনুযায়ী অবকাঠামো গড়ে তুলে মানুষ তার মরদেহ সংরক্ষণ করতে পারবে অনন্তকাল যেমন করেছিল পিরামিড নির্মাতারা। এমনকি, একইভাবে নিজের শারীরিক ক্রিয়াদি (Body metabolism) নিয়ন্ত্রণ করে হয়তো ঠেকিয়ে রাখতে পারবে বার্ধক্য বা আয়ুষ্কালেও। কিন্তু এরপরও সম্ভব নয় মৃত্যু থেকে বাঁচা। কারণ জীবন বা রূহ হলো আল্লাহর হুকুম বা নির্দেশ (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত-৮৫) এবং কোন হুকুমকেই কখনো কোন অবকাঠামোতে আবদ্ধ রাখা যায় না।

সূরা কাহাফে বর্ণিত গুহাবাসীরা এখনও তাদের গুহার মধ্যে ঘুমন্ত নাকি মৃত তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও তারা যে এখনও সেখানে বর্তমান এটা সুনিশ্চিত। কারণ অনন্য অবস্থান ও গঠন শৈলীর জন্য ঐ গুহাতে কোনকিছু পচে-গলে নিঃশেষ হওয়া সম্ভব নয়। (দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০ মে ২০০৮)