আল কুরআনে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর গুণবাচক নাম

পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে অদ্যাবধি যে ব্যক্তিত্বের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, যাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অসংখ্য ইতিহাস, রচনা, প্রবন্ধ, কবিতা ও গান,তিনি হলেন­ মানবতার মহান পরম বন্ধু মহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাঃ। স্বয়ং আল্লাহরাব্বুল আলামিন তাঁর নামকে সুউচ্চ মিনারের সর্বোচ্চ চূড়ায় স্থান দিয়েছেন। আল কুরআনে তাঁর বিভিন্ন গুণবাচক নাম উল্লেখ করে তাঁকে মর্যাদার আরো উচ্চশিখরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তোমার জন্য তোমার খ্যাতির কথা বুলন্দ করেদিয়েছি।” (সূরা আলাম নাশরাহঃ ৪) এমনকি আল্লাহ তায়ালা তাঁর অসীম ক্ষমতা বলে কাফেরদেরমাধ্যমে তাঁর আলোচনাকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

নিম্নেআল কুরআনে আলোচিতবিভিন্ন গুণবাচক নাম আলোচনা করা হলোঃ

১. মুহাম্মদঃ আল কুরআনে এনামটি চার বার এসেছে। যথাঃ সূরা আলে ইমরানঃ ১৪৪, সূরা আহজাবঃ ৪০, সূরা মুহাম্মদঃ ২,সূরা আল ফাতাহঃ ২৯। মুহাম্মদ অর্থ প্রশংসিত।

২. আহমাদঃ আহমাদ নামটি আল কুরআনে শুধু একবার সূরা সফে এসেছে।আহমাদ শব্দের দু’টি অর্থ। এক. ‘অধিক প্রশংসিত’, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যিনিসবচেয়ে বেশি প্রশংসার যোগ্য। দুই. আল্লাহর সর্বাধিক প্রশংসাকারী। ‘আর স্মরণ করোঈসা ইবনে মারিয়ামের সেই কথা যা তিনি বলেছিলেনঃ ‘হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের কাছেআল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আমি সেই তাওরাতের সত্যতা প্রতিপাদনকারী যা আমার আগে এসেছেএবং একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা যিনি আমার পরে আসবেন, যার নাম ‘আহমাদ’। (সূরা সফ)

৩. নবীঃ ‘নাবা’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ সংবাদ। রাসূল সাঃ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর বাণী পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। কোন পথেমানুষের মুক্তি এবং কোন পথে শয়তান ফাঁদ পেতে বসে আছে তার সংবাদবাহক রাসূল সাঃঅসংখ্য পথ ও মতের মধ্যে তিনি সঠ িক পথের সংবাদবাহক।

৪. রাসূলঃ দূত বা বার্তাবাহক। (হে নবী) ‘আমি তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা নিসাঃ ৭৯) মানুষের শিক্ষা ও হিদায়াতের জন্য তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন বার্তাবাহক ছাড়া আর কিছু নহেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী) তুমি বলে দাও, আমি তোমাদেরই মতো মানুষ। আমি তো মানুষরাসূল ছাড়া কিছুই নই।’

৫. মুয্‌যাম্মিলঃ চাঁদর আবৃতব্যক্তি। ‘হে চাদর আবৃতকারী, রাত্রির কিয়দংশ জাগো, অর্ধেক রাত্রি অথবা তার চেয়েকিছু কম অথবা কিছু বেশি এবং তারতিলের সাথে কুরআন তেলাওয়াত করো। নিশ্চয় আমি তোমারওপর গুরুভার দায়িত্ব অর্পণ করেছি।’ (সূরা মুয্‌যাম্মিলঃ ১)

৬. মুদ্দাসসিরঃ বস্ত্র মুড়িদিয়ে শয়নকারী। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী, ওঠো এবং সাবধানকরে দাও, তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো, তোমার পোশাক পবিত্র রাখো,অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক।’ (সূরা মুদ্দাস্‌সিরঃ ১-৫)

৭. শাহিদঃসাক্ষ্যদানকারী। ‘হে নবী নিশ্চয়ই আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা।’ (সূরা আহজাবঃ৪৫) অর্থাৎ আল্লাহর শিক্ষা ও হিদায়াতের সাক্ষ্যদানকারী, ইসলামের রূপরেখা বা চিত্রেরজ্বলন্ত নমুনা।

৮. বাশির ও মুবাশ্বিরঃ সুসংবাদদানকারী। তিনি সৎকর্মশীলদের কল্যাণ ও সৌভাগ্যের সুসংবাদদানকারী। ‘হে নবীনিশ্চয়ই আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সুসংবাদদানকারী হিসেবে।’ (সূরা আহজাবঃ ৪৫) প্রকৃতইরাসূলুল্লাহ সাঃ-এর পয়গাম ছিল মানবজাতির জন্য অনেক বড় সুসংবাদ।

৯. মুনজির ও নাজিরঃ ভীতি প্রদর্শনকারী। অর্থাৎ এখনো যারা সত্যসম্পর্কে অজ্ঞ, রাসূল সাঃ ছিলেন তাদের সতর্ক ও সাবধানকারী। ‘হে নবী আমি আপনাকেপাঠিয়েছি ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে।’ (সূরা আহজাবঃ ৪৫)

১০. আমিনঃ বিশ্বস্ত। নবী আকরাম সাঃ তাঁর উন্নত চরিত্র ওমাধুর্যমণ্ডিত স্বভাবের কারণে স্বতন্ত্র এবং বিশিষ্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন সবার চেয়েঅধিক বক্তিত্ব সম্পন্ন, সবার জন্য নিরাপদ ও বিশ্বস্ত আশ্রয়স্থল। আরো ছিলেন একজন সম্মানিত প্রতিবেশী, বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ, সর্বাধিক দূরদর্শিতাসম্পন্ন জ্ঞানী, সত্যবাদী, কোমল প্রাণ ও পবিত্র পরিচ্ছন্ন মনের অধিকারী। অঙ্গীকার পালনে, প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ও আমানত আদান প্রদানে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তাই স্বজাতির লোকেরা তাঁকে আল আমিন নামে ভূষিত করেন।

১১. হাদিঃ পথ প্রদর্শকঃ রাসূল সাঃ ছিলেন সিরাতুল মুস্তাকিমেরপ্রদর্শক। মানবজাতি যখন আদিম জাহেলিয়াতের কোলে ঘুম গিয়েছিল, সভ্যতা যখন প্রগাঢ়অন্ধকারে ডুবেছিল, চারদিকে বিরাজ করছিল উত্তেজনা, মানুষ মানুষে সঙ্ঘাত, যুদ্ধ ওলুটপাটের তাণ্ডবে মেতে উঠেছিল, অসংখ্য পথ ও মতের যাঁতাকলে মানুষের নাভিশ্বাস শুরুহয়েছিল, তখন লাখো চাঁদের আলো নিয়ে হেরা থেকে নেমে এলেন সিরাতুল মুস্তাকিমেরপ্রদর্শক মুহাম্মদ সাঃ। লক্ষ্যচ্যুত জাতিকে তিনি পথের দিশা দিলেন।

১২. নূরঃ আলো। রাসূল সাঃ অন্ধকার পৃথিবীর এক আলোকিত মহামানব।তাঁর আগমনের পর সব অন্ধকার দূরীভূত হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা তাঁর আগমনে বলেছেন,‘সত্য এসেছে, মিথ্যা অপসৃত হয়েছে, মিথ্যা তো পরাজয় ধ্বংস হবেই।’ তাঁর শিক্ষা ওচরিত্র যেমন ছিল আলোকিত ও ঝলমল, তেমনি তাঁর বাস্তব অবয়বও ছিল সূর্য ঝিকমিক। তাঁরচলনে-বলনে, আচার আচরণে লক্ষ চাঁদের আলো এসে আছড়ে পড়ত। তাঁর দৈহিক সৌন্দর্যসম্পর্কে আবু কারসনার মা ও খালা বলেন, ‘আমরা এমন সুদর্শন মানুষ আর দেখিনি। আমরা ওরমুখ থেকে আলো বিকীর্ণ হতে দেখেছি।’ হজরত আবু হোরায়রা বলেন, ‘রাসূল সাঃ-এর চেয়েসুদর্শন কাউকে দেখিনি। মনে হতো যেন সূর্য ঝিকমিক করছে।’

১৩. সিরাজুম মুনিরাঃ মূর্তিমান আলোক ও প্রদীপ। অর্থাৎ তাঁরব্যক্তিত্ব ও জীবন আমাদের পথের অন্ধকার দূরীভূতকারী উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। ‘হে নবীআমি তোমাকে সাক্ষ্যদানকারী, সুসংবাদদানকারী ও সতর্ককারী, আল্লাহর নির্দেশে তাঁরদিকে আহ্বানকারী এবং উজ্জ্বল প্রদীপ বানিয়ে পাঠ িয়েছি। (সূরা আহজাবঃ ৪৫-৪৬)

১৪. দায়ী ইলাল্লাহঃ আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী। অর্থাৎ পথভ্রষ্ঠলোকদেরকে আল্লাহ পথে আহবানকারী। পথহারা মানুষকে তিনি সঠিক ঠ িকানায় পৌঁছে দিয়েছেন।‘হে নবী আমি তোমাকে সাক্ষ্যদানকারী, সুসংবাদদানকারী এবং সতর্ককারী, আল্লাহরনির্দেশে তাঁর দিকে আহ্বানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপ বানিয়ে পাঠিয়েছি। (সূরা আহজাবঃ৪৫-৪৬)

১৫. রহমতঃ অনুগ্রহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নবী) আমি যেতোমাকে পাঠিয়েছি, এটা আসলে দুনিয়াবাসীর জন্য আমার রহমত।’ (সূরা আম্বিয়াঃ ১০৭) হজরতমুহাম্মদ সাঃ আগমন আসলে সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমত বা অনুগ্রহ। কারণতিনি এসে অন্ধকারে নিমজ্জিত বিশ্বকে জাগিয়ে তুলেছেন। বিশ্বমানবতা যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল, এই বুঝি আদ-সামুদ জাতির ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছে, অকস্মাৎআল্লাহর গজব এসে আছড়ে পড়বে হয়তো এখনি। কিন্তু রাসূল সাঃ-এর কারণে সমগ্র মানব জাতি অবশ্যম্ভাবী এক ধ্বংস থেকে মুক্তি পেল। ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন করুণার আধার। তাঁর চাচা আবু তালিব কোনো এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায়ই বলতেন, ‘তিনি সুদর্শন,তাঁর চেহারা থেকে বৃষ্টির করুণা প্রত্যাশা করা হয়। তিনি এতিমদের আশ্রয় তিনিবিধবাদের রক্ষাকারী।

**************************

জাফরআহমাদ

দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৪ এপ্রিল ২০০৮