মিরাজ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ ওপরে উঠার সিঁড়ি বা সোপান। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় বান্দা বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাঃ-কে ঊর্ধ্বলোকে তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। সে ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে মিরাজুন্নবী সাঃ বা নবী সাঃ-এর মিরাজ তথা ঊর্ধ্বগমন বলে খ্যাত। মিরাজের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে আরবি ‘ইসরা’ শব্দ ব্যবহার করেও আল কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা ইসরা বা বনী ইসরাঈলের প্রথম আয়াতে বলা হয়েছেঃ “পবিত্র ও মহামহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের আঁধারে ভ্রমণ করিয়েছিলেন ‘মসজিদুল হারাম’ বায়তুল্লাহ হতে ‘মসজিদুল আকসা’ বায়তুল মুকাদ্দাসে, যার পরিবেশ আমি আল্লাহ বরকতময় করেছিলাম তাঁকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখানোর জন্য।” এই আয়াতে নবী করীম সাঃ-এর মিরাজের সীমানা বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত বলা হলেও অন্য আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে ঊর্ধ্বগমন করে আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। বহু তাফসিরকারকের মতে, আল্লাহর বাণী ‘তিনি তো তাঁর প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলি দেখেছিলেন।’ (৫৩:১৮)
মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল নবী করীম সাঃ-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তাঁর মক্কী জীবনের শেষ দিকে। অবশ্য এর সঠিক তারিখ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। তবে অধিকাংশের মতে, হিজরতের তিন বছর আগে রজব মাসের ২৭ তারিখের রাতে তিনি জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে ‘বোরাক’ নামক বাহনযোগে মক্কা মুকাররমা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়েছিলেন এবং সেখানে সব নবী-রাসূলের ইমাম হয়ে নামাজ আদায় করে সশরীরে ঊর্ধ্বলোকে গমন করেন। আল কুরআনের পাশাপাশি বহুসংখ্যক বিশুদ্ধ হাদিসেও মিরাজের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
হাদিসগুলোর মর্মানুযায়ী মিরাজের রাতে নবী করীম সাঃ কাবা ঘরের হাতিম অংশে কাত হয়ে শুয়েছিলেন। এমন সময় ফিরিশতা জিব্রাইল আঃ তাঁর কাছে এসে তাঁর বক্ষবিদারণ করেন এরপর তিনি তাঁর কলব বের করে তা ধৌত করলেন। কলব ধৌত করার পর তা ঈমানে পরিপূর্ণ করে আবার তা তার নিজস্ব জায়গায় প্রতিস্থাপন করেন। প্রতিস্থাপনের পর জমজমের পানি দ্বারা তাঁর পেট ধৌত করে বোরাক নামক এক তড়িৎ যানে তাঁকে আরোহণ করানো হয়। এরপর হজরত জিব্রাইল আঃ তাঁকে নিয়ে বোরাকযোগে ঊর্ধ্বলোকে রওনা হলেন। প্রথম আসমানে যাওয়ার পর দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো আপনি কে? বললেন, আমি জিব্রাইল এবং আমার সাথে নবী মুহাম্মদ সাঃ। আবার জিজ্ঞেস করা হলো তাকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? জিব্রাইল আঃ বললেন, হ্যাঁ। তখন তাঁকে খোশ আমদেদ বলে ভেতরে নেয়া হলো। তিনি সেখানে গিয়ে দেখলেন হজরত আদম আঃ রয়েছেন। জিব্রাইল আঃ তখন তাঁকে বললেন, ইনি আপনার আদি পিতা হজরত আদম আঃ, তাকে সালাম করুন। তিনি তখন তাঁকে সালাম করলেন। তিনি সালামের জবাব দিয়ে নবী মুহাম্মদ সাঃ-কে উদ্দেশ করে বললেন, ‘নেককার পুত্র ও নেককার নবীর প্রতি আমার সাদর সম্ভাষণ।
এরপর জিব্রাইল আঃ নবী করীম সাঃ-কে নিয়ে দ্বিতীয় আসমানে গেলেন। সেখানে গিয়েও প্রথম আসমানের অনুরূপ ঘটনা ঘটল। দরজা খোলার পর সেখানে হজরত ঈসা আঃ ও তাঁর জ্ঞাতি ভাই হজরত ইয়াহিয়া আঃ-এর সাথে সাক্ষাৎ হলো। সাক্ষাতে তিনি তাদের দু’জনকে সালাম করলেন। তাঁরা দু’জন সালামের জবাব দিয়ে নবী করীম সাঃ-কে বললেন, নেককার ভাই ও নেককার নবীর, প্রতি সাদর সম্ভাষণ।
দ্বিতীয় আসমান ভ্রমণের পর জিব্রাইল আঃ নবী করীম সাঃ-কে নিয়ে তৃতীয় আসমানে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি হজরত ইউসুফ আঃ-এর সাক্ষাৎ পেলেন এবং পরিচয়ের পর তাঁকে সালাম করলেন। হজরত ইউসুফ আঃ তাঁর সালামের জবাব দিয়ে নবী করীম সাঃ-কে উদ্দেশ করে বললেন, ‘নেককার ভাই ও নেককার নবীর প্রতি খোশ আমদেদ।’
এরপর হজরত জিব্রাইল আঃ নবী করীম সাঃ-কে নিয়ে চতুর্থ আসমানে গেলেন। সেখানে গিয়ে সাক্ষাৎ হলো নবী হজরত ইদ্রিস আঃ- এর সাথে তিনিও নবী মুহাম্মদ সাঃ-এর সালামের জবাব দিয়ে তাঁকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘নেককার ভাই ও নেককার নবীর প্রতি খোশ আমদেদ।
চতুর্থ আসমানে ভ্রমণের পর হজরত জিব্রাইল আঃ নবী করীম সাঃ-কে নিয়ে পঞ্চম আসমানে আরোহণ করলেন। সেখানে গিয়ে হজরত হারুন আঃ-এর সাথে সাক্ষাৎ হলো। তিনিও অনুরূপভাবে সালাম বিনিময় করে নবী করীম সাঃ-কে লক্ষ্য করে বললেন, ‘নেককার ভাই ও নেককার নবীকে সাদর সম্ভাষণ।
এরপর হজরত জিব্রাইল আঃ নবী করীম সাঃ-কে নিয়ে ষষ্ঠ আকাশে আরোহণ করলেন। সেখানে দেখা হলো হজরত মুসা আঃ-এর সাথে। হজরত মুসা আঃ নবী মুহাম্মদ সাঃ-এর সাথে সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর কেঁদে ফেলেন এবং তিনি তাঁর কাঁদার কারণ হিসেবে বললেন, তাঁর উম্মতের চেয়ে নবী মুহাম্মদ সাঃ অধিকসংখ্যক উম্মত জান্নাতবাসী হবে। ষষ্ঠ আকাশের পর হজরত জিব্রাইল আঃ নবী মুহাম্মদ সাঃ-কে নিয়ে সপ্তম আকাশে আরোহণ করলেন এবং সেখানে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম আঃ-এর সাথে সাক্ষাৎ হলো। তিনি নবী করীম সাঃ-এর সালামের জবাব দিয়ে তাঁর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘নেককার পুত্র ও নেককার নবীর প্রতি সাদর অভিনন্দন।
সপ্তম আকাশ ভ্রমণের পর হজরত জিব্রাইল নবী মুহাম্মদ সাঃ-কে নিয়ে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গেলেন। সেখানে তাঁকে বায়তুল মামুর পরিদর্শন করানো হলো। এই বায়তুল মামুরে দৈনিক ৭০ হাজার ফিরিশতা প্রবেশ করেন। ফিরিশতাদের সংখ্যা এত বেশি যে, যারা একবার এই বায়তুল মামুরে প্রবেশ করেন কেয়ামত পর্যন্ত তাঁদের সেখানে প্রবেশ করার পালা আসবে না। সেখানে নবী করীম সাঃ স্বচক্ষে জান্নাত ও জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করেন। এরপর নবী করীম সাঃ-এর সামনে একপাত্র মদ, একপাত্র দুধ এবং একপাত্র মধু আনা হয়। তিনি এর মধ্য থেকে দুধের পাত্রটি গ্রহণ করেন। তখন হজরত জিব্রাইল আঃ বললেন, এটা ফিৎরত বা স্বভাব ধর্মের নিদর্শন। আপনি এবং আপনার উম্মত এই স্বভাব ধর্ম ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবেন। এরপর নবী মুহাম্মদ মোস্তফা সাঃ-এর ওপর ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হলো। পরবর্তীতে পুনঃ পুনঃ আবেদনের প্রেক্ষিতে আল্লাহপাক দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ উম্মতে মুহাম্মদির ওপর ফরজ করেন, যা ইসলামের পাঁচটি রুকনের অন্যতম রুকন বা ভিত্তি। আর এই নামাজই মানুষকে যাবতীয় পাপাচার ও অনাচার থেকে রক্ষা করে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে তৈরি করে।
কেউ কেউ বলতে চান নবী করীম সাঃ-এর মিরাজ দৈহিক ছিল না। তা ছিল স্বপ্নযোগে। কথাটা আদৌ যুক্তিসঙ্গত নয়। কেননা তাই যদি হতো তবে তাতে আশ্চর্যের বিষয় কী ছিল? স্বপ্নে তো অনেকেই অনেক কাজ করে থাকে। তাতে তো আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকে না। সুতরাং এটা দিবালোকের মতো সত্য যে, নবী করীম সাঃ-এর মিরাজ জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে সংঘটিত হয়েছিল এবং তা পরদিন নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করার কারণে হজরত আবু বকর রাঃ ‘সিদ্দিক’ উপাধি পেয়েছিলেন।
আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতেও সশরীরে নবী করীম সাঃ-এর মিরাজ সম্পূর্ণ সম্ভব। অবশ্য পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তি অতিক্রম করে ঊর্ধ্বলোকে গমন সম্ভব নয় বলে কোনো কোনো প্রাচীন বিজ্ঞানী মনে করতেন এবং সে দিক থেকে তারা মনে করতেন যে এর ফলে মিরাজ উপলক্ষে ঊর্ধ্বলোকে গমন সম্ভব নয়। কিন্তু মধ্যাকর্ষণ নীতির দোহাই দিয়ে যারা মিরাজকে অস্বীকার করতেন আধুনিক বিজ্ঞানীরা সেই নীতিকে আজ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বলছেন, শূন্যে অবস্থিত কোনো স্থূল বস্তুকে পৃথিবী যে সব সময় সমভাবে আকর্ষণ করতে পারে না। আজ তা পরীক্ষিত সত্য। কেননা প্রত্যেক গ্রহের একটি নিজস্ব আকর্ষণী শক্তি আছে। পৃথিবীর যেমন আকর্ষণী শক্তি আছে, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহেরও তেমনি আকর্ষণী শক্তি আছে। সূর্য ও পৃথিবীর একে অন্যকে টেনে রাখছে। এই টানাটানির ফলে পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এমন একটা স্থান আছে যেখানে কোনো আকর্ষণ-বিকর্ষণ নেই। তাই পৃথিবীর কোনো বস্তু যদি এই নিউট্রন জোনে পৌঁছতে পারে অথবা এই সীমানা অতিক্রম করে সূর্যের সীমানায় পৌঁছে যেতে পারে তবে তার আর পৃথিবীতে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। গতি বিজ্ঞান স্থির করেছে, পৃথিবী থেকে কোনো বস্তুকে যদি প্রতি সেকেন্ড ৬.৯০ অর্থাৎ মোটামুটি সাত মাইল বেগে ঊর্ধ্বলোকে ছুড়ে দেয়া যায়, তবে তা আর পৃথিবীর বুকে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং আধুনিক বিজ্ঞানের এই সূত্র প্রমাণ করে, মিরাজ সংঘটন সম্পূর্ণ সম্ভব এবং বাস্তব। তা ছাড়া আধুনিক যুগে মানুষ যেখানে মহাশূন্যে পাড়ি দিচ্ছে সেখানে গোটা বিশ্বজগতের মহান সৃষ্টিকর্তা তার প্রিয় নবী বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাঃ তাঁরই সান্নিধ্যে নিয়ে যাবেন তাতে বাধা কোথায়?দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২১ মার্চ ২০০৮