ইসলামী জীবন ব্যবস্হা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। বর্তমান পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই যে চরম উৎকর্ষ তা ইসলামেরই অবদান-এ কথা সবাই স্বীকার করছেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) জ্ঞানালোক ও সভ্যতার যে বিরাট প্রাসাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন করেন তা পৃথিবীকে অলংকৃত করে আসছে তার সময়কাল থেকেই। পবিত্র কোরআন মাজিদে মুসলমানদের বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে-‘হে আমাদের রব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর।’ তাছাড়া সাহাবায়ে কিরাম মহানবী কে (সাঃ) বলতে শুনেছেন-‘জ্ঞান হচ্ছে মুমিনের জন্মগত অধিকার, যেখানেই এটা দেখ গ্রহণ কর।’
রাসুলে কারীম (সাঃ)-এর নিকট ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ রমজান রাতে নাজিলকৃত ওহীর প্রথম কথাতেই অধ্যয়ন করার নির্দেশসহ মানব সৃষ্টিতত্ত্ব ও কলমের উল্লেখ গবেষণা করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করে। প্রথম নাজিলকৃত সুরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াতে বলা হয়েছে ‘পড়, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত হতে। পড়, আর তোমার প্রভু মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে সকল সৃষ্ট জীবনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন। মানুষের এই মর্যাদা তার জ্ঞান-বুদ্ধির জন্যই। মহান আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের অসম্মতি সত্ত্বেও হজরত আদমকে (আঃ) সৃষ্টি করেন। তারপর তাকে সকল কিছুর নাম শিক্ষা দেন। এই নাম শিক্ষা মানেই জ্ঞান ও বিদ্যা। আর বিদ্যা অর্জনের মাধ্যমেই হজরত আদম (আঃ) ফেরেশতাদের থেকে সেজদা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন অর্থাৎ সম্মানের শীর্ষ পর্যায়ে উন্নীত হন। পবিত্র কোরআনুল কারীমে বলা হয়েছে ‘আর স্মরণ কর যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি পাঠাতে যাচ্ছি। ফেরেশতারা বলল-আপনি কি সেখানে এমনকিছু পাঠাবেন যারা অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার প্রশংসা, মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, আমি যা জানি তোমরা তা জান না। আর তিনি আদমকে যাবতীয় বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়ে সেগুলোকে ফেরেশতাদের সামনে প্রকাশ করলেন এবং বললেন, এগুলোর নাম আমাকে বল, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ (সুরা আল-বাক্কারাহ, আয়াত নং-৩০-৩১)। আমরা জানি, অতঃপর ফেরেশতারা হজরত আদম (আঃ)-এর জ্ঞান-বিদ্যার কাছে পরাজিত হয় এবং আল্লাহ পাকের নির্দেশে হজরত আদমকে (আঃ) সেজদা করে।
পবিত্র কোরআনুল কারীম জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক অফুরন্ত ভান্ডার। বিজ্ঞানের যে কোনো শাখার সুস্পষ্ট নিদর্শন আল-কোরআন থেকে লাভ করা সম্ভব। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-‘শপথ বিজ্ঞানময় কোরআনের।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত নং-২)। ‘আকাশ ও পৃথিবীতে এমন কোনো গোপন রহস্য নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে উল্লেখ নেই।’ (সুরা আন-নামল, আয়াত নং-৭৫)।
আল্লাহ পাক সমগ্র বিশ্ব জগতের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক। তিনি মানুষকে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা করার তাকীদ প্রদান করেছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-‘নিশ্চয়ই আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য, যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্হায় আল্লাহ পাককে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আকাশমন্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টির বিষয়ে এবং বলে-হে আমাদের রব! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা একমাত্র তোমারই।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত নং-১৯০-১৯১)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে ‘নিশ্চয়ই আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানগুলোতে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর আল্লাহ তাআলা আকাশ থেকে যে পানি নাজিল করেছেন, তদ্বারা মৃত জমিনকে সজীব করে তুলেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সব রকম জীব-জন্তু। আর আবহাওয়া পরিবর্তনে এবং মেঘমালায় যা তারই নির্দেশের অধীনে আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর মাঝে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা আল-বাক্কারাহ, আয়াত নং-১৬৪)
বিজ্ঞান চর্চার অসংখ্য নিদর্শন কোরআন মাজিদে বিদ্যমান রয়েছে। যেমন-আলোকবর্ষের
পরিমাপ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-‘ফেরেশতাগণ ও রুহ আল্লাহ তাআলার দিকে ঊর্ধ্বগামী হয়
এমন একদিকে, যার পরিমাণ পার্থিব পঞ্চাশ হাজার সমান।’ (সুরা আল-মা’আরিজ, আয়াত নং-৪)।
এছাড়া সমুদ্র ও পর্বত সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে-“তিনিই কাজে লাগিয়ে
দিয়েছেন সমুদ্রকে, যাতে তা থেকে তোমরা তাজা মাছ খেতে পার, তা থেকে বের করতে পার
পরিধেয় অলংকার। তুমি তাতে জলযানসমুহকে পানি চিরে চলতে দেখবে এবং যাতে তোমরা আল্লাহ
তাআলার কৃপা অন্বেষণ কর এবং যাতে তার অনুগ্রহ স্বীকার কর। আর তিনি পৃথিবীর ওপর
বোঝা রেখেছেন যে, কখনো যেন তা তোমাদের নিয়ে হেলে-দুলে না পড়ে এবং নদী ও পথ তৈরি
করেছেন যাতে তোমরা তোমাদের গন্তব্যস্হলে পৌঁছতে পার। আর তিনি নির্ণায়ক বহু চিহ্ন
সৃষ্টি করেছেন এবং তারকা দ্বারাও মানুষ পথের নির্দেশ পায়।” (সুরা আন-নাহাল, আয়াত
নং-১৪-১৬)।
পবিত্র কোরআনেউদ্ভিদ বিজ্ঞানের নানা নিদর্শন রয়েছে। যেমন ইরশাদ
হয়েছে-“তারা কি ভুপৃষ্ঠের দিকে দৃষ্টিপাত করে না? আমি তাতে প্রত্যেক প্রকারের কত
উদ্ভিদ উদগত করেছি। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী
নয়।” (সুরা আশ-শুয়ারা, আয়াত নং-৭-৮)।
মধু ও মৌমাছি সম্পর্কে পবিত্র কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে-“আপনার পালনকর্তা মৌমাছিকে তার অন্তরে ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ দিলেন-পাহাড়ে, বৃক্ষে ও উঁচু চালে গৃহ তৈরি কর, এরপর সর্বপ্রকার ফল থেকে ভক্ষণ কর এবং আপন পালনকর্তার উন্মুক্ত পথসমুহ অনুসরণ কর। ফলে তার পেট থেকে বিভিন্ন বর্ণের পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সুরা আন-নাহল, আয়াত নং-৬৮-৬৯)।
পানি থেকেই যে পৃথিবীতে প্রথম জীবনের উদ্ভব ঘটেছে এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে-“অবিশ্বাসীরা কি ভাবে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্তু সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এরপরও কি তারা বিশ্বাস স্হাপন করবে না?” (সুরা আল-আম্বিয়া, আয়াত নং-৩০)।
আল কোরআনুল কারীমে জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে এ ধরনের আরো অসংখ্য আয়াতে কারীমা রয়েছে যেগুলোকে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে গবেষণা করে মুসলিম বিজ্ঞানীগণ বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে সমর্থ হয়েছিলেন যা পরবর্তী সময়ে ক্রুসেডের মাধ্যমে মুসলমানদের কাছ থেকে পাশ্চাত্যে চলে যায়। সৃষ্টিতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষ শাস্ত্র, পদার্থ, রসায়ন, খনিজ বিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রাণীবিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, বিদ্যুৎ, আলো, তাপ, অংকশাস্ত্র, মহাশুন্যে গবেষণাসহ বিজ্ঞানের সকল উন্নতিই মুসলমানদের কোরআন মাজিদের আলোকে গবেষণার ফসল।
আধুনিক বিজ্ঞানের গতি মুলত সঞ্চারিত করে যান মুসলিম বিজ্ঞানীরাই। বিজ্ঞান চর্চার জন্য বাগদাদে আব্বাসী খলিফা মামুনুর রশীদ ‘বায়তুল হিকমাহ’ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিজ্ঞানের অনেক শাখারই জনক মুসলিম বিজ্ঞানীরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাশাআল্লাহ ও আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ আল নিহাওয়ান্দী আজো শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী। মাশাআল্লাহকে ফিনিক্স লকবে অভিহিত করা হয়। তিনি গোলকের মন্ডল, গ্রহ-নক্ষত্রের গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ে অবদান রেখেছেন। আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ আন নিহাওয়ান্দী জ্যোতিষ্ক মন্ডল নিরীক্ষণ করে আল-মুস্তামান নামে নিখুঁত ছক বানান। বিজ্ঞানী আবুল হাসান দুরবীক্ষণ যন্ত্রের উদ্ভাবক এবং পেন্ডুলামের দোলনের সাহায্যে সময়ের পরিমাণ স্হির করে ঘড়ির উদ্ভাবন করেন মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে ইউসুফ। এলজ্যাবরা, ত্রিকোণমিতিসহ কেমিষ্ট্রি (আল-কিমিয়া), শল্য বিদ্যা, বায়ুর গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ক যন্ত্র ইত্যাদি সবকিছুই মুসলিম বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন। এছাড়াও অন্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে জাবির ইবনে হাইয়ান-যিনি রসায়ন বিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত, ওমর খৈয়াম, ইবনে সীনা, আবু যায়দ আল আনসারী, আল-খাওয়ারিজমী, ইবনে বাজ্জা, হুনায়ন ইবনে ইসহাক, বাত্তানী, ওমর ইবনুল ওয়ারদী, ইবনে আওয়াম, কাযবীনী, আবু মা’শার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
মুসলিম বিজ্ঞানীদের তালিকা যত বিশাল তাদের অবদানের তালিকা আরো বিশাল, আর এটা ইসলামে বিজ্ঞান চর্চার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপের ফলেই সম্ভব হয়েছে। পবিত্র কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে “তিনি (আল্লাহ) সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহতাআলার সৃষ্টিতে কোনো ত্রুটি দেখতে পাবে না। পুনরায় তাকিয়ে দেখ, কোনো ফাটল দেখতে পাও কি? অতঃপর তুমি বার বার তাকিয়ে দেখ তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে।’ (সুরা আল-মুলক, আয়াত নং-৩-৪)। আমার দেশ, ১৩ জুলাই ২০০৮