ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এত বাস্তবমুখী ও ফলপ্রসূ যে, ইসলাম প্রকৃতি বা পরিবেশ সম্পর্কে মৌলিক নীতিমালা উপস্থাপন করেছে যা পৃথিবীর অন্য কোন জীবন ব্যবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রথমেই আমরা বলতে পারি আমাদের চারপাশের পরিমন্ডল, আকাশ, বাতাস, মাটি, পানি, গাছপালা ইত্যাদি যা পরিবেশ হিসাবে খ্যাত এগুলো সবই মহান স্রষ্টার অপূর্ব নিয়ামত। এ সবকিছু মহান আল্লাহর অসীম কুদরতের নিদর্শন। দুনিয়ার সকল সৃষ্টি মৌলিকভাবে দু’টো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। এক• দুনিয়ার সকল সৃষ্টি মানুষসহ অন্যান্য সৃষ্টির প্রতি নিরলসভাবে সেবাদান করে চলেছে। মনে রাখা দরকার পৃথিবীর কোন কিছু নিরর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। পবিত্র কুরআন মজিদে আল্লাহ তা’য়ালা বলছেনঃ তুমি কি দেখ না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যারা আছে তারা এবং উড্ডীয়মান বিহঙ্গকুল আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে? প্রত্যেকেই জানে তার ইবাদতের ও পবিত্রতা ঘোষণার পদ্ধতি এবং ওরা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত’। (সূরা নূর, ২৪:৪১)। কুরআন মজিদে আরো বর্ণিত হয়েছে ‘আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং উহাদের মধ্যে কোন কিছুই ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি, আমি এ দুটি অযথা সৃষ্টি করিনি, কিন্তু উহাদের অধিকাংশই ইহা জানে না’। (সূরা দুখান, ৪৪:৩৮-৩৯)। অন্যত্র বিধৃত হয়েছে ‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন’। (সূরা বাকারা, ২:২৯)।
প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে ইসলামের আরেকটি মৌলিক নীতি হলঃ প্রকৃতির অন্যান্য সৃষ্টির কোনরূপ ধ্বংস, বিনাশ, অপচয় বা অপব্যবহার করা যাবে না। প্রত্যেকটি সৃষ্টি কোন না কোনভাবে মানুষ অথবা অন্য কোন সৃষ্টিকে সেবাদান করে। পরিবেশ ধ্বংসের যে কোন ধরনের উদ্যোগ বা চেষ্টা মানুষসহ অন্যান্য সৃষ্টিকে আল্লাহ প্রদত্ত সেবা থেকে বঞ্চিত করার সামিল। বিনা প্রয়োজনে অযৌক্তিকভাবে মহান আল্লাহ তা’য়ালা কর্তৃক বরাদ্দকৃত কোন সেবা থেকে বঞ্চিত করার কোন নৈতিক অধিকার কিন্তু মানবজাতিকে প্রদান করা হয়নি।
পৃথিবীর কোন সৃষ্টির জীবন নির্বাহ করতে যাতে কোনরূপ অসুবিধা না হয় সেজন্য আল্লাহ তা’য়ালা সকলের প্রয়োজন ও চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে সবকিছু পরিমিতভাবে সৃষ্টি করেছেন। কুরআন পাকে ইরশাদ হয়েছেঃ ‘আমি প্রত্যেক কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে।’ (সূরা কামার, ৫৪:৪৯)। আরো বর্ণিত হয়েছেঃ ‘:•এবং আমি ওতে প্রত্যেক বস্তু উদগত করেছি সুপরিমিতভাবে’। (সূরা হিজর, ১৫:১৯)। গঠন ও প্রকৃতির দিক থেকে ভিন্নতা থাকলেও সবকিছু পরিমিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। দুনিয়ায় অপরিমিতভাবে এমন কিছু সৃষ্টি করা হয়নি যা মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন এবং জীবনের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে।
দুনিয়ার যাবতীয় প্রাকৃতিক সমপদ ব্যবহারের নিরঙ্কুশ এখতিয়ার আল্লাহ তা’য়ালা একমাত্র মানবজাতিকে প্রদান করেছেন। সে কারণে পরিমাণগতভাবে হোক অথবা গুণগতভাবে হোক যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও হিফাযতের দায়িত্ব মানবজাতির ওপর বর্তায়। অপ্রয়োজনে এবং অযৌক্তিকভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস বা বিনাশ করার কোন এখতিয়ার মানবজাতির নেই। এ জাতীয় তৎপরতা সর্বদা অনৈতিক কাজ হিসাবে বিবেচিত হবে। মহান স্রষ্টা কর্তৃক পরিমিতভাবে সুবিস্তৃত প্রাকৃতিক সম্পদের চমৎকার নেটওয়ার্কের কোনরূপ ক্ষতি করা যাবে না। আমাদের মনে রাখা দরকার প্রকৃতি বা প্রকৃতির উপাদান মানুষ ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্টির জন্যও প্রয়োজনীয়। প্রাকৃতিক সম্পদও তাদের জন্য দরকারী।
প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষেত্রে আরো একটি মৌলিক নীতি হল মানুষ নিরঙ্কুশভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রকৃত মালিক নয়। প্রাকৃতিক সম্পদ উৎপাদন, ভোগ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব হল একজন ম্যানেজারের মত। Environmental protection in Islam শীর্ষক একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধে ড• আবু বকর আহমদ বাগাদার যথার্থই বলেছেন, ’ And as such he is only a manager of the earth and not a proprietor; a beneficiary and not a disposer or ordainer'.
স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাপনের জন্য যেসব সম্পদ বা উপকরণ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় বা অত্যাবশ্যকীয় তা মহান আল্লাহতা’য়ালা সৃষ্টি করে মানবজাতির নিকট ন্যস্ত করেছেন। মানবজাতির ট্রাস্টি হিসাবে এসব সম্পদ ব্যবহারের অধিকার প্রদান করা হয়েছে। শুধু মানবজাতিকে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের এখতিয়ার প্রদান করা হয়নি অন্যান্য সৃষ্টিরও সমভাবে সকল প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের অধিকার রয়েছে। কোরআন মজিদে বিধৃত হয়েছেঃ ‘তিনি স্থাপন করেছেন অটল পর্বতমালা ভূ-পৃষ্ঠে এবং উহাতে রেখেছেন কল্যাণ এবং চারদিনের মধ্যে উহাতে ব্যবস্থা করেছেন খাদ্যের সমভাবে যাচনাকারীদের জন্য’। (৪১:১০)। প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ড• আবু বকর আহমদ বাগাদার অন্যত্র বলছেন- 'Hence, man should take every precaution to ensure the interests and rights of all others since they are equal partners on earth •
প্রকৃতির সকল উপকরণ, যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ সুষ্ঠু, ন্যায়ানুগ ও কল্যাণকর ব্যবহারের ওপর ইসলাম গুরুত্ব আরোপ করে। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমিত ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত উদার ও ইতিবাচক। প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়, বিনাশ অথবা অপরিমিত ব্যবহার কোনটিই ইসলামের দৃষ্টিতে সমর্থনীয় নয়। ইসলাম পরিবেশ সংকটের অবসান প্রত্যাশা করে। কেননা পরিবেশ সংকট উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। ইসলাম উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব‘গত ও আত্মিক উন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলাম নৈতিকতা বা মূল্যবোধ কোনটিকে উপেক্ষা করে না। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে উন্নয়নের ধারণা দুনিয়ার কল্যাণ ও পারলৌকিক মঙ্গল-এর ধারণা থেকে উৎসারিত।
এবার জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। ভূগোলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যেসব কারণগুলোর কথা বলা হয়েছে তারমধ্যে তাপমাত্রার পরিবর্তন, বৃষ্টিপাত, মাটির উপাদান, বন-জঙ্গলের পরিমাণ ইত্যাদি অন্যতম। এগুলোর সাথে পরিবেশ সংকটের অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক রয়েছে। পরিবেশ দূষণ অথবা পরিবেশ সংকটের কারণে পরোক্ষভাবে বা প্রত্যক্ষভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বন জঙ্গল উজাড় হচ্ছে, বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনে যেসব নিয়ামকগুলো সক্রিয় পরিবেশ সংকটের কারণে সৃষ্ট অবস্থার সাথে সেগুলোর একটা সম্পর্ক রয়েছে।
সমকালীন প্রেক্ষাপটে পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলামের শিক্ষা, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যকে যৌক্তিকভাবে সাধারণ মানুষের নিকট তুলে ধরা খুব জরুরী। দ্বিতীয়তঃ পরিবেশের সাথে দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করা ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ইসলামের শিক্ষা, ঐতিহ্য ও অনুভূতিকে বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করা দরকার। একটা বিষয় আমাদের মনে রাখা দরকার ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন সমুদ্রে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে।’ (সূরা রূম, ৩০:৪১)। পবিত্র কুরআন মজিদে মানুষকে সতর্ক করে বিধৃত হয়েছে- ‘তোমরা নিজেরা নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনো না।’ ইসলামের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কল্যাণকর শিক্ষার আলোকে আমরা যদি পরিবেশের সাথে সুআচরণ করি তাহলে পরিবেশ সংকট থেকে অনেকাংশে উত্তরণ সম্ভবপর। গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে ইসলামের শিক্ষা ও মূল্যবোধ বহুলাংশে সহায়ক হবে। দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০ মে ২০০৮